১৪টি দ্বীপের শহরে | তালহা যুবায়ের | ৩য় পর্ব

  সিঁড়িগুলো চলছে যেন পাতাল ফুঁড়ে অনন্তের পথে তার আগে ২২ তারিখ, একটা সুন্দর সূর্যোদয় নিয়ে বার্গেন থেকে রওনা দিয়েছিলাম, তুষারে ঢাকা অসলো তে বি...

 

সিঁড়িগুলো চলছে যেন পাতাল ফুঁড়ে অনন্তের পথে

তার আগে ২২ তারিখ, একটা সুন্দর সূর্যোদয় নিয়ে বার্গেন থেকে রওনা দিয়েছিলাম, তুষারে ঢাকা অসলো তে বিরতী দিয়ে অতঃপর নরওয়ের একসময়কার রাষ্ট্র পরিচয়, বর্তমানে প্রতিবেশি রাষ্ট্র সুইডেনের রাজধানী মেঘে ঢাকা আঁধারে স্টকহোমে। নামার সময় মেঘের নিচে নেমে শুধু কিছু উদোম বন ছাড়া কিছুই চোখে পড়লো না। তুষারে সাদা হয়ে আছে রানওয়ের বাইরের অংশটা। বিশাল এয়ারপোর্ট, ৫ টা টার্মিনাল মোট। যেই বাসে করে গন্তব্যে যাবো, সেটির টার্মিনালে যেতে নেমে যেতে হলো মাটির নিচের মেট্রো স্টেশনে। বিশাল চলন্ত সিঁড়িতে মনে হচ্ছিলো মাটি ফুঁড়ে চলে যাচ্ছি অন্য কোন গন্তব্যে। প্রায় ১২-১৫ তলা উচ্চতার সমান গভীরে নামলাম। সুইডেনের আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রো নির্মিত হয়েছিলো ১৯৫০ সালে। ইউরোপের অন্যতম পুরোনো মেট্রো। আকারেও বেশ বড় ট্রেনগুলো, অনেকটা দুরপাল্লার ট্রেনগুলোর মত। হওয়ারই কথা, যেহেতু প্রায় ১ মিলিয়ন মানুষের বাস এই স্টকহোমে। সবথেকে অদ্ভুত লেগেছিলো মাটির নিচে এর স্টপেজের দেয়ালগুলোতে অদ্ভুত সব আর্টগুলো। ডিনামাইট দিয়ে ফাটানো এবড়ো থেবড়ো দেয়ালগুলোতে কখনো মনে হয়েছে বাচ্চাদের আঁকিবুঁকি আবার কখনো মনে হয়েছে কতটা নিঁখুত এই আর্টওয়ার্ক। পরে জানলাম এটাকে পৃথিবীর সবথেকে দীর্ঘতম শিল্প গ্যালারী বলা হয়। এরপর বাসের জন্য অপেক্ষা করতে করতে মনে হলো -৩° ডিগ্রী তাপমাত্রা হলেও মাইনাস ৮-১০° ডিগ্রীতে আছি। এরপর সুইডেনে প্রথম অনুভূতি হলো, নির্মানশৈলী আবহাওয়া আর গাছপালাতো নরওয়ের মতই। যদিও বাস থেকে দেখা দুরের গ্রামের কটেজগগুলো নরওয়েজিয়ানদের থেকে কিছুটা আলাদা। নরওয়েজিয়ান কটেজগুলো সাধারণত দোতলা হতে দেখেছি অধিকাংশই। যদিও ছোট ছোট কটেজ রয়েছে কিছু। বাট সুইডেনের গ্রামের কটেজগুলো দেখলাম ছোট ছোট, এবং মনে হলো নির্মানের রীতিও কিছুটা ভিন্ন। রংয়ের ক্ষেত্রে যদিও ঐ লাল-হলুদ আর কালো রংয়ের প্রাধান্যই। এছাড়া পার্থক্যটা মূলত পাহাড় আর সমতল নিয়ে। স্টকহোম দেখলাম মোটামোটি সমতলই, ছোট ছোট টিলা, পাহাড় অবশ্য ছিলো। কিন্তু তা মোটেই নরওয়ের মত পর্বতসম আর সর্পিল নয়। এছাড়া নরওয়ের অধিকাংশ অংশই যেমন সাগরের গা ঘেষে পাহাড়ের গায়ে গড়ে উঠেছে ফিওর্ডের অপরিসীম নিরব সৌন্দর্য বুকে নিয়ে সেখানে স্টকহোমে ঐ সোদারস্ট্রম নদীকে ঘিরে যা সৌন্দর্য। এর বাইরে নরওয়েতে যেহেতু অধিকাংশ বড় বড় কোম্পানিই আসে সুইডেন থেকে তাই মার্কেটের মধ্যে মনে হয়েছে নরওয়েতেই আছি। ইউলা, রুস্তা, কুপ আর নরমাল এসব নিয়মিতই চোখে পড়েছে। এছাড়া যে এয়ারপোর্ট থেকে যে বাসে চড়েছি ঠিক একই কোম্পানির বাস নরওয়েতেও চলছে। পরে জানলাম স্টকহোমকে বলা হয় স্ক্যান্ডেনিভিয়ার কর্পোরেট হাব বলা হয়। এছাড়া ফুড ডেলিভারীতে সেই ফুডোরা আর নিয়মিত চোখে পড়া এইচ এন্ড এম, ড্রেসম্যান আরো নানা পরিচিত অপরিচিত ব্রান্ডগুলো। এর বাইরে সব থেকে মজার ব্যাপার হলো এখানে খাবারের দাম অনেক বেশি সস্তা। আমাদের যেখানে ম্যাকডোনাল্ডসে সব থেকে সস্তা একটা চিজ বার্গার খেতে ৩১ ক্রোনা লাগে সেখানে স্টকহোমে ১৫ ক্রোনা। রেস্টুরেন্টে যেকোন ডিশ খেতে একশত থেকে দেড়শত ক্রোনায় হয়ে যাবে অথচ বার্গেনে আড়াইশো থেকে তিনশত বলা চলে সর্বনিম্ন। মন ভরে পরিচিত তেহারী আর মোরগ পোলাও খাওয়া হয়েছে সেই বাংলাদেশ থেকে আসার পর প্রথমবার। কারণ বার্গেনে দেখেছি সাধারণত কাচ্চি, পোলাও অথবা খিচুরিই করে সবাই আর কোন দেশি রেস্তোরাঁও নেই। পরে এর কারণ জানলাম, সুইডেনে ভ্যাট কম কিন্তু ইনকাম ট্যাক্স বেশি, সেখানে নরওয়েতে ভ্যাট বেশি ও ট্যাক্স কিছুটা কম সুইডেনের চেয়ে। গড়ে সমানই হয়ে যায় কারণ বাসা ভাড়া একই রকম, খুবই চড়া। 

দীর্ঘ আঁকিবুঁকিতে ঘেরা পাতাল স্টেশনগুলো।


এছাড়া স্টকহোমই সম্ভবত পশ্চিম ইউরোপের সব থেকে বেশি অভিবাসীদের বাস। যদিও বর্তমানে ডানপন্থি সরকার ক্ষমতায় যারা কিনা অভিবাসন নীতি কঠোর করবে বলছে। মুসলিম কমুনিটি, মসজিদ, স্কুল থেকে শুরু করে বাংলাদেশী কমুনিটিও বেশ শক্তিশালী। যদিও এখানেও নানা গ্রুপ রয়েছে রাজনৈতিক বিভিন্ন চিন্তাকে প্রাধান্য দিয়ে কিন্তু তবুও মোটাদাগে সৌহার্দ্যপূর্ন সম্পর্কের কথাই শুনলাম চারপাশের মানুষদের থেকে। ভালো থাকুক এখানকার দেশী-বিদেশী সকল মানুষেরা, দেশের সব কাঁদায় ভরা বৈশিষ্ট্য দুরে ঠেলে আপন হয়ে থাকুক সবাই। 

সোনালী দিগন্তের সাথে ঝিনুকের মত জেগে থাকা ভেস্টল্যান্ডের দ্বীপগুলো।


পরবর্তীতে কোপেনহেগেন পৌঁছে পরবর্তী ফ্লাইটের জন্য গেটের দিকে হাটতে হাটতে গিয়ে ঘটে মজার এক ঘটনা। হাটতে হাটতে এগোচ্ছিলাম, হুট করেই চোখে পড়ে যায় আমাদের ইউআইবিতেই পিএইচডি রত, নানা বিষয়ে কদিনে খুবই কাছের হয়ে যাওয়া বিশাল ভাই আর হানান আপুর সাথে। আমি প্রায় পার হয়েই গিয়েছিলাম আপুকে দুর থেকে দেখে, চেনা লাগলেও চোখ সরিয়ে নিয়ে ভেবেছিলাম কোন ইন্ডিয়ান হবেন হয়তো। পরে পার হয়ে কি মনে করে পিছনে চোখ দিয়েই তাদের বাচ্চা দুটেকে দেখি। ফিরে এসে কুশল বিনিময় করে ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা এবং দুটো পুচকেকে সাথে নিয়ে বিমানে উঠা। তারা দেশ থেকে ফিরছেন দোহা হয়ে। এরপর সিট অন্য জায়গাতে হলেও তাদের পাশে সিট খালি থাকায় একসাথেই বসলাম। ডেনমার্কের আকাশে সূর্য উঠেনি তখনো, ৯টা পার হয়ে গেছে। উপরে উঠে আসলাম মেঘের, চারদিকটা সোনালী সূর্যের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠলো। এইসব অন্ধকার দিনে একটুখানি রোদ যে কতটা আনন্দের তা বুঝানো যায় না। কিছু মেঘতো গোলাপী হয়ে উঠছে সূর্যের নানা রঙের ছোঁয়া পেয়ে। ক্রমেই বাল্টিক সাগর পার হয়ে নরওয়েজিয়ান সাগরে পড়লাম। এরপর নরওয়ের তুষার ঘেরা বিস্তির্ণ পাহাড় আর উপত্যকার দিয়ে উড়তে লাগলাম ক্ষনিককাল ধরে। মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছিলো বরফ ঠান্ডা পানি নিয়ে অপেক্ষমান লেকগুলো। উপর থেকে মনে হয় ধবধবে সাদার মাঝে এক টুকরা চাঁদের কলঙ্কের মত। এসব দেখতে দেখতে বার্গেনের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছি। বার্গেনের আকাশে উপরে এর আগে দিনে উড়া হয়নি কখনো। বার্গেনে নেমেছিলাম রাতে এবং গিয়েছিলাম ও সকাল হওয়ার আগে। উপর থেকে দেখছিলাম তুষারে ঢাকা পাহাড় আর চারাপশে ঘিরে থাকা নীল সমুদ্র আর ফিওর্ড। মনে হচ্ছিলো রূপকথার কোন কল্পরাজ্যের উপর উড়ছি। যদিপ বরাবরের মতই মেঘ এসে ঢেকে দিচ্ছিলো দৃষ্টি সিমানা। তবুও মেঘের মাঝ থেকে যা উঁকি দিচ্ছিলো তাতেই মন থেকে বের হচ্ছিলো "আলহামদুলিল্লাহ, সুবহানাল্লাহ "। এর মাঝে পাইলট ঘোষনা করে, স্নোফলের কারণে বিমানের অবতরন দেরি হবে বিশ মিনিট। আর যায় কোথায়। নতুন এক অভিজ্ঞতা, প্রায় ত্রিশ মিনিট ধরে স্ক্যান্ডিক এয়ারলাইন্সের ছোট্ট বিমানটা পাক খেতে থাকলে আকাশে। চারদিকে ঘন মেঘের কালো সাদা নানা অংশ। কখনো ডানাদিকে কাঁত হচ্ছে বিমান আবার কখনো বাম দিকে। দেখতে পাচ্ছি জানালা দিয়ে নিচের পাহাড় আর সমুদ্রের দ্বীপগুলো সব ডাউনসাইড আপ হয়ে যাচ্ছে। এমন ঘুরপাক খেতে পৌঁছে গেলাম রানওয়তে। দেখলাম তুষারপাত হচ্ছে চারদিকে। চারদিকে খোলা হওয়ায় স্পষ্ট দেখলাম আকাশে নানা জায়গায় নানা রকমের খেলা। দুরে কোথাও মেঘ থেকে ঝরে পরছে তুষার, কোথাও পরছে না, আমদের দিকে ধেয়ে আসা মেঘের দল ততক্ষণে তুষার নামিয়েছে। অতঃপর ব্যাগেজ কালেকশনের ঝামেলা শেষে শুভ্র তুষারে ঢাকা সেই চীরচেনা বার্গেন!

সোদারস্ট্রম নদীর তীরে অবস্থিত স্টকহোমের প্রানকেন্দ্রে যাওয়ার জন্য শীতল অপেক্ষা।


২৭.১২.২২ 
বার্গেন, নরওয়ে।


COMMENTS

Name

Article,4,POEM,5,ভ্রমন কাহিনী,4,
ltr
item
T A L H A J U B A E R: ১৪টি দ্বীপের শহরে | তালহা যুবায়ের | ৩য় পর্ব
১৪টি দ্বীপের শহরে | তালহা যুবায়ের | ৩য় পর্ব
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiRzCp2ECpiM_I3qZRiJKcGiqX68XCb4GdRM_xkQBluZ2G0T47KaPQGB9SCwfokC0Cjf-h8QuNls6tNfMKo2gCc7j6lBijZEhIDoSAHP1v5JckMt6HqBOgM-uV1GAyDKgPqGVIgwKV2se28gMaOH77OArJTnUdXsCMOkGavd7S1I3zMFwEgrQBQaYD-/w640-h480/under.jpg
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiRzCp2ECpiM_I3qZRiJKcGiqX68XCb4GdRM_xkQBluZ2G0T47KaPQGB9SCwfokC0Cjf-h8QuNls6tNfMKo2gCc7j6lBijZEhIDoSAHP1v5JckMt6HqBOgM-uV1GAyDKgPqGVIgwKV2se28gMaOH77OArJTnUdXsCMOkGavd7S1I3zMFwEgrQBQaYD-/s72-w640-c-h480/under.jpg
T A L H A J U B A E R
https://www.talhajubaer.com/2023/02/blog-post_28.html
https://www.talhajubaer.com/
https://www.talhajubaer.com/
https://www.talhajubaer.com/2023/02/blog-post_28.html
true
3977557795929158617
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts VIEW ALL Readmore Reply Cancel reply Delete By Home PAGES POSTS View All RECOMMENDED FOR YOU LABEL ARCHIVE SEARCH ALL POSTS Not found any post match with your request Back Home Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy Table of Content