আমি যে ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স তথা এম ফিল করেতেছি তার নাম ইউনিভার্সিটি অফ বার্গেন। অসলোর পরে নরওয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম সিটি যেমন বার্গেন, ঠি...
আমি যে ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স তথা এম ফিল করেতেছি তার নাম ইউনিভার্সিটি
অফ বার্গেন। অসলোর পরে নরওয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম সিটি যেমন বার্গেন, ঠিক তেমনি ব্যাপ্তি
ও রেংকিংয়েও বার্গেন বিশ্ববিদ্যালয় অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের পরে নরওয়ের দ্বিতীয় । QS অনুসারে
সিরিয়াল বিশ্বে ২০৭ নম্বর। ছাত্র-ছাত্রির সংখ্যা পিএইচডির ছাত্ররা বাদে প্রায় ২০ হাজারের
মত। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ১০ টি ফ্যাকাটির অধিনে ৩৪ ডিপার্টমেন্ট ও ৬৭ টি রিসার্চ সেন্টার
পরিচালিত। যাই হোক, প্রাথমিক কথার পরে আসল
কথায় আসি। কথা হলো আমি ও আমাদের দল এখানকার ছাত্র সংসদে অংশ নিয়ে দুটি আসন নিশ্চিত
করেছি।
আমার ছাত্র সংসদে নির্বাচনে অংশ নেয়া ও জয়ী হওয়ার কথা!
গত বছর তথা ২০২২ এ কৌতুহলবশতই এখানকার স্টুডেন্ট পার্লামেন্ট তথা ছাত্র
সংসদ সম্পর্কে জানতে গিয়ে দেখলাম সব দলগুলোই নরওয়েজিয়ানদের দ্বারা পরিচালিত। পরবর্তীতে
ওখানকার একজনের কাছে জানতে পারলাম আন্তর্জাতিক ছাত্রদের জন্য থাকা একটা দলের কথা যেটার
নাম জেনারেল স্টুডেন্ট এলায়েন্স। যেটা কিনা পরিচালনা করেন বাংলাদেশীরাই। পরে খোঁজ নিয়ে
জানলাম আবু বকর সিদ্দিক অভি নামে এক ভাই হচ্ছে সেই দলের লিডার বা প্রেসিডেন্ট। গিয়ে
দেখলাম নরওয়েজিয়ান, ইরানীসহ বাংলাদেশীদের প্রভাবিত দল, যারা মূলত ইন্টারন্যাশনাল ছাত্রদের
দাবি দাওয়া নিয়ে কাজ করে। আমি কিছুটা এক্টিভ হলেও তখনও নতুন কিন্তু কি যেন মনে করে
গত বছরের ই আমাকে দলের টপ তিনজন ক্যান্ডিডেটের মধ্যে একজন করে দেন অভি ভাই। পরবর্তীতে
নির্বাচনের প্রচারনা করলাম আমরা। গত বছর আমাদের মূল এজেন্ডা ছিলো তিনটা যথা: ইন্টারন্যাশনাল
ছাত্রদের নরওয়েজিয়ান সমাজ, শিক্ষা ও বসবাসের ক্ষেত্রে উন্নত মান নিশ্চিত করা, ইন্টারন্যাশনাল
স্টুডেন্টদের জন্য ভার্সিটি কর্তৃক আরো বেশি চাকুরির সুযোগ নিশ্চিত এবং ভার্সিটির ক্যাম্পাস
কার্বন নিউট্রাল করা। আমরা পরিশেষে দেখা গেলো ৪.৫% ভোট পেলাম এবং আমাদের একটা আসন নিশ্চিত
হলো, আবু বকর ভাই হলে নির্বাচিত। আমরা যে কেউই এই আসনের মাধ্যমে পার্লামেন্টে অংশ নিতে
পারলেও আলস্যতায় এটেন্ড করা হয় নি কখনো।
এরপরে এলো এ বছরের ইলেকশন৷ ইতিমধ্যেই অভি ভাই দেশত্যাগ করেছেন। পুরোনো
ভাইয়া আপুরাও চাকুরী ও ডিগ্রি কমপ্লিট করা নিয়ে ব্যস্ত। শেষমেশ আমিই লিস্ট লিডার বা
নেতৃত্বের দায়িত্বটা কাঁধে নিয়ে নিলাম নরওয়েজিয়ান মাইকেল কে সাথে করে। নতুন আসা বাংলাদেশী
ছাত্র সামি ও মালয়েশিয়ান হাইরুলকে নতুন করে ক্যান্ডিডেটদের মধ্যে নিলাম। নতুন এজেন্ডা
বানালাম এ বছরের, এবারও তিনটা, যথা নরওয়ের সংবিধানের যে ফ্রি শিক্ষার অধিকারের কথা
বলা হয়েছে তা আন্তর্জাতিক ছাত্রদের জন্য নিশ্চিত করা (নরওয়েতে সবার জন্য শিক্ষা ফ্রি
হলেও নতুন করে ইন্টারন্যাশনাল ছাত্রদের জন্য টিউশন ফি এড করা হয়েছে), ভার্সিটি ক্যাম্পাসকে
কার্বন মুক্ত করা ও সকল ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ডাইভার্সিটি নিশ্চিত
করা। শুরু হলো ক্যাম্পেইন। এবার আমরা প্রতিটা দাবি দাওয়া নিয়ে আলাদা আলাদ ভিডিও বানালাম
এবং বুস্ট করলাম, স্টুডেন্ট পার্লামেন্টের ইন্স্টাগ্রাম আইডি একদিন প্রচারনার জন্য
ব্যবহার করলাম তুমুলভবে। ইউনিভার্সিটি অব বার্গেনের ক্যাম্পাসের অধিকাংশ জায়গাতে পোস্টার
সেটে দিলাম এবং দুইদিনের মত ক্যাম্পেইন স্টান্ড নিয়ে দাড়ালাম। এছাড়া ব্যক্তিগত লেভেলে
ব্যাচমেট আর প্রতিবেশিদের বলা তো হয়েছেই সকল ক্যান্ডিডেটসের পক্ষ থেকে। ফলাফল? প্রকাশিত
হলো গতকাল বিকালে। দুপুর বারোটায় ভোট গ্রহন শেষ এবং বিকাল ৫.৩০ এর রেজাল্ট। এবারে ২০২১ সালের মত দুটো আসন পেয়েছি। ভোটও পেয়েছি
প্রায় ৬.৫% এর মত। আমাদের নিকটতম দল গ্রিন পার্টি ও দুটি আসন পেয়েছে এবং ভোট পার্সেন্টিজ
ও অনেকটাই কাছাকাছি। আমি এবং সামি নির্বাচিত
হয়েছি, যদিও আমাদের দলের যেকেউই অংশ নিতে পারবে পার্লামেন্টের অধিবেশনে। তার মানে আমরা
এখন ডাকসুর নুরুল হক নুরুর মত বার্গেনের নুরু(আমার বন্ধু আকবরের মতে)। নুরু আর আখতার
যেমন একমাত্র লীগের বাইরের তেমনি আমি ও সামি দুজন বিদেশী বাকি সব নরওয়েজিয়ান। দেখা যাক এখন কতটুকু কি করতে পারি ইন্টারন্যাশনাল
ছাত্রদের অধিকার রাখতে। বাংলাদেশেীদের বাইরে সব থেকে বেশি ভোট সম্ভবত দিয়েছে নেপালীরা,
এছাড়া হয়তো কিছু আফ্রিকান, আরব ও নরওয়েজিয়ান ভোট পেয়েছি৷ জানিনা ভারতীয় বা পাকিস্তানীরা
ভোট দিয়েছে কিনা।
এখানকার ছাত্র রাজনীতির আলাপ
এবারে আসা যাক এখানকার ছাত্র রাজনীতির পরিস্থিতি নিয়ে। আমাদের ক্যাম্পাসে
আমরা সহ মোট দল ৬ টি। অনেকটা নরওয়ের ন্যাশনাল পার্টিগুলোর মতই। স্যোসাল ডেমোক্রেটিক
পার্টি, (বর্তমানে সবথেকে বেশি আসন, ৭টি), লেফ্ট এলায়েন্স (৫টি আসন), গ্রিন পার্টি,
মডারেট পার্টি, সাইন্স পার্টি এবং আমরা তথা জেনারেল স্টুডেন্ট এলায়েন্স। এরা রাজনৈতিকভাবে
স্বাধীন তথা আমাদের দেশের মত লেজুড় না হলেও
তাদের এজেন্ডাগুলোও কম বেশি রাষ্ট্রের মাদার পার্টিগুলোর পলিসি অনুসারেই নিয়ে থাকে।
সেই এজেন্ডাগুলো নিয়ে দলগুলো প্রচারনা চালায়। প্রচারনাটা চালানো হচ্ছে অদ্ভুত, আমাদের
বাজারে নতুন কোন পণ্য আনলে তা যেমন একটা বুথ করে করা হয় ঠিক তেমনি। আমরা স্টান্ড নিয়ে,
টেবিল ও পোস্টার নিয়ে বসি। সাথে থাকে চকলেট, পিনাট বার, কফি। সুযোগ থাকলে ওয়াফেলও
বানাই। খাবার যত বেশি বা আকর্ষনীয় থাকে আগ্রহী ছাত্রদের পরিমানও বেশি থাকে। এই প্রচারনার
খরচের জন্য পার্লামেন্ট থেকেই প্রায় ৭০ হাজার টাকার মত ফান্ড দেয়া হয়। এসব খাবার নেয়া
দেয়ার ফাকে আমরা আর দলগুলো তাদের এজেন্ডা নিয়ে আলাপ করে। এছাড়া স্টুডেন্ট পার্লামেন্টের
এক্সিকিউটিভ বোর্ড থাকে, যেখানে চাকুরী করে কিছু এক্স স্টুডেন্ট। তারা ব্যাপকভাবে প্রচারনা
করে সব দলগুলোর জন্যই এবং অনেক খাবার দাবার সহ। কখনো এনার্জি ড্রিংকস, কখনো ব্রেড,
আর কফি, ওয়াফেলতো আছেই। তবে এসব নিয়ে মিছিল মিটিংয়ের কোন বালাই নাই। ভোট দেয়ার পদ্ধতিটা
কিছুটা কঠিন। আমাদের যেহেতু একটা স্টুডেন্ট ইমেইল থাকে, সেই ইমেইল দিয়ে ওয়েবসাইটে ঢুকতে
হয় এবং যে পার্টি বা লিস্টকে ভোট দিবে তাদের সিলেক্ট করতে হয়। এরই সাথে কোন ব্যক্তিগত
পছন্দ থাকলে তাকেও ক্লিক করতে হবে। এমন করে মোট ভোটের পার্সেন্টিজের উপর দল এবং পারসোনাল
চয়েজের ভোটের উপর দলের মধ্যে টপ ক্যান্ডিডেট সিলেক্ট হয় পার্লামেন্টের জন্য। রেক্টর
তথা ভিসি এসে ছোট্ট বক্তৃতা দেন এরপরই পাবলিশ হয় রেজাল্ট। বার্গেনের স্টুডেন্ট টিভি
ও স্টুডেন্ট নিউজ ছাড়া তেমন কোন টিভিকে দেখিনি।
তারপরও এখানে ভোটের হার খুবই কম। বাংলাদেশে যেখানে ভোট দেই আমরা লাইন ধরে,
আর ১০৩% ভোট কাস্ট হয়। এখানে প্রায় ২০ হাজার
ছাত্রের মধ্যে ভোট পরেছে মাত্র ১৩.৫%। তার ভিত্তিতেই দলগুলোতে ২৪ টি আসন বিন্যস্ত হয়েছে।
মোট আসন ৩১ টি। বাকি আসনগুলো ফ্যাকাল্টি থেকে মনোনীত হয়। এছাড়া আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
সিনেটের মত এখানকার সর্বোচ্চ ডিসিশন কমিটি হলো ইউনিভার্সিটি বোর্ড। সেখানের জন্য দুজন
ইলেকশন করা হয় ঠিক একই সময়ে। মোট দশজন মেম্বার থাকে সেই বোর্ডের, যার মধ্যে দুজন ছাত্র
হয়। ভার্সিটির রেক্টর তথা ভিসির নেতৃত্বে সেই বোর্ড থাকে। আমাদের পার্লামেন্টের রেজোল্যুশন
বা প্রস্তাবনাগুলো মূলত ঐ দুজন ছাত্র প্রতিনিধির হাত ধরে মূল বোর্ডে যায়৷ এবং নরওয়েজিয়ান
সিস্টেমে স্টুডেন্ট পার্লামেন্টের ডিসিশনকে খুব শক্ত প্রস্তাবনা হিসেবেই নেয়া হয়। যেমন
আমাদের পিছনের দিনগুলোর প্রস্তাবনা অনুসারে ২৪ ঘন্টা লাইব্রেরি খোলা রাখা হচ্ছে, ইন্টারন্যাশনাল
স্টুডেন্টদের জন্য স্টুডেন্ট এডভাইজর ও ক্যারিয়ার মেন্টরশিপ চালু করা হয়েছে। এভাবে
করে ছাত্র সংশ্লিষ্ট নানা সংস্কার পার্লামেন্টের প্রস্তাবনা, ছোটখাটো রেলি করার মাধ্যমেই
হয়ে থাকে। যদিও সরকারি কোন আইন পরিবর্তন হলো সেক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের থেকে
সরকারকেই বেশি গুরুত্ব দেয় যেটা বরং স্বাভাবিক। তবে সমস্যা হলো সব আলাপ নরওয়েজিয়ানে
করা হয়। তবে আমাদের জন্য ট্রান্সেলেটরের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং ইংরেজিতে অনেক ফরমালিটি
ম্যানেজ করা হয়। এর বাইরে বলার মত বিষয় হলো আমাদের দেশের মত ভিপি, জিএস বা এসব দায়িত্বের
ভাগ নেই। ন্যাশনাল পার্লামেন্টের মতই সংখ্যাগরীষ্ঠ দল ও অপজিশন দল থাকলেও মোটা দাগে
সবাইই সমান৷ শুধু প্রথম পার্লামেন্ট মিটিংয়ে স্পিকারসহ তথা কিছু এক্সিকিউটিভ নির্বাচন
করা হয় বেতনভুক্ত জব হিসেবে।
নির্বাচন করতে গিয়ে আদৌ কোন লাভ আছে?
কেউ চাইলে ভাবতে পারেন যে আসলে সমাজিক ও ধর্মীয় দিক দিয়ে এতে আদৌ কোন উপকার
বয়ে আনে কিনা বিদেশী ছাত্রদের সুযোগ সুবিধা বা ধর্মীয় ক্ষেত্রে। আমার উত্তর হলো বড়
বড় ক্ষেত্রে না হলেও ছোট ছোট ক্ষেত্রে কাজে দেয়, যেহেতু মেজর বিষয়গুলো রাষ্ট্রের পলিসি
অনুসারে পরিবর্তন হয় যেমন টিউশন ফি দেয়ার রুলস বা বিদেশীদের জন্য ছাত্র লোন বন্ধ করে
দেয়া। ছোট ক্ষেত্রের কথা বলতে গেলে উপরে দুটি প্রস্তাবনা পাশের কথা বলেছি যেটা আমাদের
প্রস্তাব ছিলো আগের বছরগুলো তে। এছাড়া ইউআইবির ক্যাম্পাস কার্বন নিউট্রাল করার ক্ষেত্রেও
অনেক এগিয়েছে যেটা আমাদের দুতিনটা দলের দাবি ছিলো এবং আছে। এছাড়া স্টুডেন্ট সেন্টারের
নামাজের জায়গা হওয়ার পিছনেও স্টুডেন্টের দাবি দাওয়ার ভূমিকা ছিলো। এর বাইরে আমি আসার
পর থেকে কতগুলো ব্যাপারে ইনপুট দিয়েছি ত বলছি।
* গত বছরের আগের বছরের এজেন্ডায় ছিলো স্যানিটারি সুবিধার জন্য পাব্লিক
প্লেসে বিভিন্ন জায়গায় চকলেটের মত করে জন্ম নিরোধোক ক্যাপ রাখার দাবি, সেটাকে গতবছর
আমি ও অভি ভাই সরিয়ে দিয়েছিলাম।
* এ বছরের রিজ্যুলিউশনে ছিলো এখানকার ক্যাম্পাসগুলোর সকল খাবার ভেজিটারিয়ান
করার প্রস্তাব, আমরা শক্তিশালী ভাবে না বলেছি
সকলের মিট খাবার স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে।
* এখনকার রুলসে ইউআইবি ক্যাম্পাসের কোন ইভেন্টে অ্যালকোহলের ফান্ড দেয়া
হয় না, সেটা উঠিয়ে নেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিলো। আমরা সেটাকে অপজ করেছি।
* সারা বিশ্বের বর্তমান সময়ের হটকেট জেন্ডার আইডেন্টি ইস্যুতে জেন্ডার
নিউট্রাল বাথরুম করার প্রস্তাব করা হয়েছিলো, আমরা সেটাকে অপজ করেছি নারীর উপর হ্যারেজমেন্টের
শংকা দেখিয়ে।
এছাড়াও কমন সাধারন অনেকগুলো বিষয়ে আমরা মতামত দিয়েছি যেমন ক্যাম্পাস বাস
সার্ভিস বাড়ানো, সকল ক্লাস ভিডিও হওয়া ও অনলাইনে এটেন্ড করার সুবিধাসহ আরো নানা বিষয়।
এখন দেখা যাক বাকসু তথা বার্গেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদে কতটুকু কি করতে
পারি বিদেশী ছাত্রদের জন্য। আল্লাহ ভরসা।
COMMENTS